ভূমিকা:
ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশে আজ এক অন্যতম প্রধান ধর্ম। তবে এই ধর্ম কীভাবে বাংলার মাটিতে প্রবেশ করলো, কে এই ধর্ম প্রচারে প্রথম এসেছিলেন, কিভাবে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রাচীন ইতিহাসে।
ইসলাম আগমনের প্রেক্ষাপট:
ইসলাম ধর্মের উত্থান ঘটে ৭ম শতাব্দীতে (৬১০ খ্রিস্টাব্দে) আরব অঞ্চলে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। এরপর মুসলিম ব্যবসায়ী, সুফি দরবেশ, ও সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ইসলাম বিস্তার লাভ করে এশিয়া, আফ্রিকা, ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে।
বাংলাদেশ তথা বাংলায় ইসলাম আগমন ঘটে তার কিছুদিন পরেই—৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে ধাপে ধাপে।
ইসলাম প্রচারের প্রথম ধাপ: আরব বণিক ও নাবিকরা
বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চল যেমন:
- চট্টগ্রাম,
- সন্দ্বীপ,
- নোয়াখালী,
- বরিশাল—এ সব জায়গায় প্রাচীনকালে আরব বণিকেরা বাণিজ্য করতে আসতেন।
এই বণিকদের একটি অংশ ছিলেন মুসলিম। তাঁরা ব্যবসার পাশাপাশি ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য ও নৈতিকতা স্থানীয়দের মাঝে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। ধারণা করা হয়, তারা ৭ম অথবা ৮ম শতাব্দীতেই বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে ইসলাম পরিচিত করে তোলে।
প্রমাণ: চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন কবরস্থান, মসজিদ ও আরবি শিলালিপি থেকে ধারণা করা যায় ইসলাম খুব প্রাচীনকালেই এখানে এসেছিল।
সুফি দরবেশ ও অলিরা: মূল ইসলাম প্রচারক
যদিও আরব বণিকরা ইসলাম এনেছিলেন, তবে ব্যাপক প্রচার ও মানুষের ইসলাম গ্রহণ ঘটেছিল মূলত সুফি দরবেশ ও অলিদের মাধ্যমে।
তাঁরা ছিলেন শান্তিপূর্ণ, আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, যারা স্থানীয় ভাষায় ইসলাম প্রচার করতেন এবং সমাজসেবার মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতেন।
উল্লেখযোগ্য সুফি অলিরা:
- হযরত শাহ জালাল (রহ.) – ১৩০৩ সালে সিলেট বিজয়ের পর ইসলাম সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়ায়।
- হযরত শাহ মখদুম রূপোশ (রহ.) – রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন।
- খাজা খিজির (রহ.) – বরিশাল অঞ্চলে প্রচার করেন।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার একটি বড় ধাপ: মুসলিম শাসন
১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ইসলাম শুধু ধর্ম হিসাবে নয়, রাষ্ট্রশক্তি হিসাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুসলিম শাসকরা মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ করেন এবং ইসলাম প্রচারে উৎসাহ দেন। এই সময়ে বাংলার শহরাঞ্চলে ইসলাম বিস্তার লাভ করে।
স্থানীয় জনগণের ইসলাম গ্রহণের কারণসমূহ:
- সুফিদের মানবিক আচরণ ও সহজ ভাষায় ধর্ম প্রচার।
- বর্ণবৈষম্যহীনতা – ইসলাম জাতি, গোত্র বা বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য করে না।
- আধ্যাত্মিক তৃপ্তি ও সমতা-বোধ।
- সামাজিক ন্যায় ও মানবতা-ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা।
উপসংহার:
বাংলাদেশে ইসলাম শুধুমাত্র এক বাহ্যিক দখল বা জোরপূর্বক আরোপিত ধর্ম ছিল না। এটি ছিল এক ধাপে ধাপে বিস্তার লাভ করা বিশ্বাস, যা মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল মানবতা, ন্যায়, ও আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে। আজ বাংলাদেশে ইসলাম যে একটি প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত—তার মূল ভিত্তি এই সুফিদের নিষ্ঠা, আরব বণিকদের প্রাথমিক প্রচেষ্টা, এবং মুসলিম শাসকদের অবদানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
রেফারেন্স:
- “বাংলার ইতিহাস” – নিশাত প্রকাশনী
- “সুফি আন্দোলন ও বাংলায় ইসলাম প্রচার” – ড. এম. এ. বারী
- বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও আরকাইভস